Bengali Translation of “The Golden Bird” for IML Day Drive

By Radharani Das

All entries to our IML Day Drive are licensed under CC BY 3.0

অনেক দিন আগে এক রাজার ছিল এক সুন্দর ফলের বাগান আর সেই বাগানে ছিল একটি সুন্দর সোনার আপেল ফলের গাছ. ওই আপেল গুলোকে গুনে রাখা হতো, কিন্তু দেখা গেল যখনই ওই আপেল পেকে যেত প্রতি রাতেই একটি করে আপেল হারিয়ে যাচ্ছে. তা দেখে রাজামশাই খুবই রেগে গেলেন এবং বাগানের রক্ষক মালিকে নির্দেশ দিলেন সারা রাত বাগানে পাহারা দিতে. মালি তখন তার বড় পুত্রকে বাগান পাহারায় নিযুক্ত করলো. কিন্তু মাঝরাতে বড় পুত্র গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পরে. যথারীতি সে রাতেও আরো একটি সোনার আপেল চুরি হয়ে গেল. পরবর্তী রাতে মালি তার দ্বিতীয় পুত্রকে পাহারায় পাঠালো. কিন্তু মাঝরাতে দ্বিতীয় পুত্রও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পরে এবং সে রাতেও সোনার আপেল চুরি যায়. ভীত-সন্ত্রস্ত মালি তখন অজানা আশঙ্কায় তার তৃতীয় পুত্রকে বাগান পাহারায় পাঠাতে সম্মত হলো না. কিন্তু যা হোক উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত সে রাজি হয়ে গেল. যথা সময়ে তৃতীয় পুত্র আপেল গাছের নিচে শুয়ে সময়ের প্রতিখ্খা করতে লাগলো. ঠিক ঘড়িতে বারোটা বাজার সাথে সাথেই সে শুনতে পেল বাতাসে শন শন আওয়াজ আর তার পরেই দেখতে পেল একটি সোনার পাখি সশব্দে ডানা মেলে উড়ে এসেছে. সেই সোনার পাখিটি সোনার আপেল ফল তার ঠোঁট দিয়ে কেটে নিতে উদ্যত হলো. সঙ্গে সঙ্গে মালির তৃতীয় পুত্র সচকিত হয়ে লাফিয়ে উঠে পাখিটির দিকে সজোরে তীর ছুড়ে মারলো. কিন্তু তীরটি পাখিটিকে বিদ্ধ্ করতে পারল না. কেবল মাত্র একটি সোনার পালক পাখিটির লেজ থেকে খসে পড়ল আর পাখিটি উড়ে পালিয়ে গেল. পরদিন সকালে ওই পাখির খসে পড়া সোনার পালকটি রাজদরবারে রাজা এবং সভাসদগনের সামনে রাখা হলো. সবাই একমত হয়ে বললেন যে ওই সোনার পালকটির কাছে রাজকোষের সমস্ত সম্পদই নগন্য. তখন রাজা মশাই ঘোষণা করলেন, “পাখিটির একটি মাত্র পালক যথেষ্ট নয় আমার জন্য, আমি সেই সোনার পাখিটিকে পেতে চাই”.

রাজার ঘোষণা অনুযায়ী মালির বড় পুত্র সোনালী পাখির সন্ধানে যাত্রা শুরু করলো. সে ভাবলো যে কাজটি অতি সহজেই সম্ভব হবে. অল্প কিছুদুর যাবার পর সে একটি গভীর বনে এসে পৌছলো. অদুরেই দেখতে পেল একটি শেয়াল আপন মনে বসে আছে. শেয়ালটিকে দেখতে পেয়েই সে তাকে তীরবিদ্ধ করতে চাইলে শেয়ালটি তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো, “আমাকে প্রাণে মেরো না; আমি জানি যে তুমি সোনালী পাখির উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছ. আমার কথা শোন. এখান থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই তুমি একটি গ্রামে পৌছে যাবে. ওখানে পৌছে তুমি দুটো পরস্পর মুখোমুখি সরাইখানা দেখতে পাবে. একটি সরাইখানা অতি সুন্দর ও আরামদায়ক. তুমি সেখানে যাবে না. বরং উল্টো দিকের নোংরা ও অপেখ্কাকৃত অপরিছন্ন সরাইখানাটিতেই আশ্রয় নেবে.” কিন্তু মালির বড়পুত্র ভাবলো, “এই তুচ্ছ প্রাণীটি এত সব জানবে কি করে?” এই চিন্তা করেই সে শেয়ালের দিকে তীর ছুড়ে মারলো. কিন্তু তীরটি শেয়ালের গায়ে লাগলো না এবং সে লেজ গুটিয়ে গভীর বনে পালিয়ে গেল. বড়পুত্রটি তারপর পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা ছুইছুই সেই গ্রামটিতে পৌছে গেল যেখানে পাশাপাশি দুটো সরাইখানা অবস্থিত. সে লক্ষ্য করলো, একটি সরাইখানাতে পান-ভোজন ও নৃত্য-গীত চলছে এবং অপরটির পরিবেশ নিরানন্দ ও মলিন. সে ভাবলো, “যদি আমি এই আনন্দের পরিবেশ ছেড়ে নোংরা ও নিরানন্দ স্থানটিতে যাই তাহলে তা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না.” এই ভেবে সে বিলাসবহুল সরাইখানাটিতে গিয়ে মনের সুখে পান-ভোজনে মগ্ন হয়ে পড়ল. ভুলে গেল নিজের দেশ ও সোনালী পাখির কথা.

দীর্ঘ সময় বয়ে চলল. যখন বড়পুত্রের বাড়ি ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না, তখন দ্বিতীয়পুত্র সোনালী পাখির সন্ধানে যাত্রা শুরু করলো. পথে যেতে যেতে সেও যথারীতি শেয়ালের দেখা পেল ও তার পরামর্শ শুনলো. কিন্তু যখন সে দুটো সরাইখানার কাছাকাছি এলো, সে বড় ভাইকে উজ্জ্বল সরাইখানাটির জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখল. সেই সরাইখানার হাসি-গান-আনন্দের শব্দ শুনে সেও ওই বিলাসবহুল সরাইখানাতে ঢুকে পড়ল. ফলে সেও বড়ভাইয়ের মত নাচ-গান-আনন্দে আত্মহারা হয়ে সোনালী পাখি ও তার নিজের দেশের কথা ভুলে গেল.
এভাবে দীর্ঘ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল. মালির দুই ছেলের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না. এবারে ছোটছেলে সোনালী পাখির সন্ধানে পৃথিবী পরিক্রমায় যেতে চাইল. কিন্তু স্নেহশীল পিতা তাকে অজানা আশঙ্কায় কোথাও যেতে দিতে চাইলেন না. যাইহোক সেও শেষপর্যন্ত সোনালী পাখির সন্ধানে যাত্রা শুরু করলো. যাত্রা শুরুতে সেও কিছুদুর গিয়ে যথারীতি বনের ধরে পৌছালো, শেয়ালের সাথে তার দেখো হলো এবং তার সুপরামর্শ মনোযোগ দিয়ে শুনলো. কিন্তু অন্য দুই ভাইয়ের মত সে শেয়ালের সাথে কোনো বিরূপ আচরণ করলো না. তখন শেয়াল তাকে বলল, “আমার লেজ শক্ত করে ধরে বস, আমি তোমাকে দ্রুত তোমার গন্তব্যস্থানে নিয়ে যাব.” ছোটছেলে শেয়ালের কথা মত কাজ করল এবং শেয়ালও তাকে নিয়ে বাতাসের মত তীব্র গতিতে পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে ছুটে চলল.

তারপর ওরা সেই গ্রামটিতে পৌছালো এবং শেয়ালের পরামর্শ অনুযায়ী ছোট ছেলে নোংরা ও অপরিছন্ন সরাইখানায় আরাম করে রাত কাটিয়ে দিল. সকাল বেলায় শেয়াল আবার এলো এবং যাত্রা শুরু করার আগে তাকে সব বুঝিয়ে বলতে লাগলো, “এবারে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে. সামনে এগুলেই দেখতে পাবে একটি দুর্গ এবং তাতে একদল সৈন্য নাক ডাকিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন. তোমার লক্ষ্য ওরা নয়. তুমি আরো সামনের দিকে এগিয়ে একটি কোঠায় কাঠের খাঁচায় সোনালী পাখিকে দেখতে পাবে. পাখিটির পাশেই দেখতে পাবে আরো একটি সুন্দর সোনার খাঁচা. কিন্তু সাবধান, তুমি পাখিটিকে কাঠের খাঁচার বাইরে বের করে ওই সুন্দর সোনার খাঁচায় ঢোকাবার চেষ্টা কোরবে না. তাহলে তোমাকে এর জন্য পরিনামে আফশোষ ও দুঃখ ভোগ করতে হবে.” এই বলে শেয়াল তার লেজ বিছিয়ে দিল এবং ছোটছেলে তার উপর বসে বাতাসের মত শনশন করে পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে ছুটে চলল.

দুর্গটির দরজায় পৌছে মালিপুত্র চারদিকে তাকিয়ে দেখল শেয়ালের কথা মতই সবকিছু ঠিকঠাক আছে. সে দুর্গে প্রবেশ করলো এবং একটি ঘরে কাঠের খাঁচায় ঝোলানো সোনালী পাখিকে দেখতে পেল. তার নিচে রাখা আছে সুন্দর সোনার খাঁচাটি. আরো লক্ষ্য করলো যে, চুরি যাওয়া তিনটি সোনার আপেলও কাছেই রাখা আছে. সে তখন ভাবলো, “আহা! এমন সুন্দর পাখিটি এমন একটি পুরনো খাঁচায় বড়ই বেমানান.” যেমন ভাবা তেমনি কাজ. সে পুরনো খাঁচাটির দরজা খুলে পাখিটিকে সুন্দর সোনালী খাঁচায় ঢুকিয়ে দিল. আর যায় কোথায়, পাখিটি সজোরে এমন চিত্কার শুরু করে দিল যে সমস্ত সৈন্য বাহিনী জেগে গেল. জেগে উঠেই তারা তাকে বন্দী করে রাজার সামনে হাজির করলো. পরদিন সকালে বিচার সভায় স্থির হলো যে, সে যদি বাতাসের মত তীব্র গতিতে দৌড়তে পারে এমন একটি সোনালী ঘোড়া এনে দিতে পারে তাহলেই তার প্রাণদন্ড মুক্ত করে দেওয়া হবে এবং সে সোনালী পাখিটিকেও নিয়ে যেতে পারবে.

সুতরাং আবারও মালিপুত্র গভীর দুঃখে পথ চলতে লাগলো. হঠাত তার শেয়াল বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল. শেয়াল তখন তাকে বলল, “বন্ধু, দেখলে তো আমার উপদেশ না শোনার ফল. যাইহোক মনোযোগ দিয়ে শোনো কিভাবে তুমি সোনালী ঘোড়ার সন্ধান পাবে. এখান থেকে সোজা গিয়ে একটি দুর্গ দেখতে পাবে. তারই ভেতরে আস্তাবলে দাড়িয়ে আছে সুন্দর সোনালী ঘোড়া. ঘোড়ার পাশেই দেখবে গভীর ঘুমে অচেতন সহিস. তুমি চুপিসারে ঘোড়াটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে. তবে সাবধান, পুরনো চামড়ার তৈরী আসনটিতেই তুমি বসবে, পাশে রাখা সোনার আসনটি স্পর্শ করবে না.” তারপর শেয়ালের লেজের উপর বসে ওরা বাতাসের মত দুরন্ত বেগে পেরিয়ে গেল অনেক পাহাড় পর্বত. দুর্গে পৌছে মালির ছোটছেলে দেখতে পেল সোনালী আসনের উপর হাত রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে ঘোড়ার সহিস. কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চামড়ার আসন দেখে মালিপুত্রের মনে খুব দয়া হলো. সে ভাবলো, “আমি ঘোড়াটিকে সোনার আসনটিই দেব. সুন্দর সোনার আসনটিই সোনালী ঘোড়ার যোগ্য.” বলাই বাহুল্য, যে মহুর্তে সে সোনার আসনটি স্পর্শ করলো, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার রক্ষক ও প্রহরীরা জেগে উঠে তাকে বন্দী করে ফেলল. পরদিন সকালে বিচার সভায় তাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হলো. তবে পরে সকলের সন্মতি নিয়ে এটা স্থির হলো যে, সে যদি সুন্দরী রাজকুমারীকে নিয়ে আসতে পারে তবেই সে প্রাণদন্ড মুক্ত হবে এবং ফিরে পাবে তার সোনালী পাখি ও সোনালী ঘোড়া.

দুঃখিত মনে সে পথ চলতে লাগলো আর আবারও তার দেখা হয়ে গেল বৃদ্ধ শেয়ালের সঙ্গে. শেয়ালটি তাকে বললো, “কেন তুমি আমার কথা শোনোনি, তাহলে আজ তুমি সোনালী পাখি ও সোনালী ঘোড়া উভয়েরই মালিক হয়ে যেতে. যা হোক, আবার আমি তোমাকে পরামর্শ দিছি. এখান থেকে সোজা চলতে থাকবে এবং সন্ধ্যার মধেই একটি দুর্গে পৌছে যাবে. ঠিক রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে দেখতে পাবে রাজকুমারী স্নানঘরের দিকে যাছে. ঠিক সেই সময় তুমি রাজকুমারীর কাছে পৌছে যাবে ও তাকে সোহাগ চুম্বন দেবে. তারপর রাজকুমারীই তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে. কিন্তু খুব সাবধান, রাজকুমারী যেন কোনোমতেই তার পিতামাতার অনুমতি নিতে না যেতে পারে.” এই বলে শেয়ালটি তার লেজ বিস্তার করে মালিপুত্রকে নিয়ে বাতাসের মত দুরন্ত গতিতে পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে ছুটে চলল.

এভাবে চলতে চলতে তারা দুর্গের দরজায় পৌছে গেল. রাত বারোটায় মালি পুত্র দেখতে পেল রাজকুমারী স্নানের জন্য যাচ্ছে. ঠিক সময়ে সে সেখানে হাজির হয়ে রাজকুমারীকে সস্নেহ চুম্বন দিল. রাজকুমারীও খুশি হয়ে তার সঙ্গে যেতে রাজি হলো. কিন্তু যাবার আগে চোখের জলে একটিবার পিতার আশির্বাদ নেবার জন্য করুনভাবে অনুরোধ করতে লাগলো. মালিপুত্র প্রথমে রাজি না হলেও পরে কাতর কান্নায় বিচলিত হয়ে দেখা করার অনুমতি দিল. বলাই বাহুল্য, ঠিক সে সময়ই রাজপ্রাসাদের প্রহরীরা জেগে উঠে তাকে বন্দী করে ফেলল.

বন্দী মালিপুত্রকে রাজার সামনে হাজির করা হলো. ক্রুদ্ধ রাজামশাই তাকে বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে কোনো দিনও পাবে না, যদি না আট দিনের মধ্যে আমার জানালার দৃশ্য অবরোধকারী পাহাড়টিকে তুমি সরিয়ে ফেলতে পার.” সেই পাহাড়টি ছিল এতই বিশাল যে সারা পৃথিবীও ওটাকে সরাতে পারতো না. মালিপুত্র সাত দিন ধরে ওই পাহাড়টির খোদাইয়ের কাজ করে অতি অল্প অংশই সরাতে পারল. আবার সেখানে এসে হাজির হলো শেয়ালটি এবং মালিপুত্রকে বললো, “তুমি ঘুমোতে যাও, আমি তোমার জন্য কাজ করে দিছি.” পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মালিপুত্র দেখল যে বিশাল পাহাড়টি আর সেখানে নেই. সে খুব খুশি মনে রাজার কাছে গিয়ে কাজ সম্পন্ন করার সংবাদ দিল ও প্রতিশ্রুতি মত রাজকুমারীর জন্ন্য প্রার্থনা জানালো.

রাজা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজকন্যাকে মালিপুত্রের হাতে সমর্পণ করলেন. মালিপুত্র সেখান থেকে বিদায় নিয়ে কিছুদুর যাবার পর আবার শেয়ালের দেখা পেল. শেয়াল তাকে বলল, “তুমি চাইলে এখন তিনটি জিনিসই পেয়ে যেতে পার রাজকুমারী, ঘোড়া ও সোনালী পাখি.” মালিপুত্র বলল, “সে তো খুব ভালো কথা, কিন্তু কিভাবে আমরা সেগুলো লাভ করব?”

শেয়াল তখন তাকে বুঝিয়ে বলল, “তুমি আমার কথা মত কাজ করলে সব কিছুই লাভ করতে পারবে. তুমি রাজার কাছে গেলে তিনি যখন রাজকুমারী সম্পর্কে খোঁজ নেবেন তখন তুমি রাজকুমারীকে দেখিয়ে দেবে. এতে রাজা খুশি হয়ে তোমাকে সোনালী ঘোড়া দিয়ে দেবে. প্রথমে তুমি ঘোড়ার পিঠে বসবে, তাদের বিদায় জানাবে এবং সবার শেষে রাজকুমারীকে করমর্দন করে খুব তাড়াতাড়ি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে লাগাম ধরে জোরে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে.”

সব কাজ সঠিক ভাবে চলতে লাগলো; তখন আবার শেয়ালটি এসে তাকে বলল, “এবার দুর্গে পৌছে তুমি যখন সোনালী পাখির কাছে যাবে আমি তখন দরজার পাশে রাজকুমারীর সাথে থাকব. তুমি ঘোড়ায় চড়ে রাজার সাথে কথা বলবে. যখন রাজামশাই দেখবেন যে এটা সঠিক সোনালী ঘোড়া তিনি পাখিটিকে নিয়ে আসবেন. কিন্তু তুমি শান্তভাবে লক্ষ্য রাখবে যে পাখিটি সত্যিকারের সোনালী পাখি কিনা. যদি তাই হয় তুমি ঠিক তখনই পাখিটিকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে আসবে.”

শেয়ালের পরামর্শ অনুযায়ী সব কাজই যথারীতি চলছিল. মালিপুত্র সোনার পাখিটিকে নিয়ে রাজকুমারীর সাথে সোনার ঘোড়ায় চড়ে ঘভীর বন পার হয়ে যেতে লাগলো. কিছুক্ষণ চলার পর শেয়ালটি সেখানে হাজির হয়ে মালিপুত্রকে বলল, “আমার একটি বিশেষ অনুরোধ রইলো; এবারে তুমি আমার মাথা ও পা শরীর থেকে কেটে বাদ দিয়ে দাও.” কিন্তু মালিপুত্র কিছুতেই এমন কাজ করতে রাজি হলো না. তখন শেয়ালটি তাকে বলল, “ঠিক আছে, যাইহোক আমি আবারও তোমাকে সুপরামর্শ দিছি. দুটো জিনিস মনে রেখো. প্রথমতঃ, ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে কাউকে মুক্ত করবে না. দ্বিতীয়তঃ কোনো নদীর কিনারায় বসবে না.” এই বলেই শেয়াল বিদায় নিল. মালিপুত্র চলতে চলতে ভাবলো, “এই পরামর্শ মেনে চলা কি আর এমন কঠিন কাজ.”

তারপর মালিপুত্র রাজকুমারীকে নিয়ে সজোরে ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে গেল সেই গ্রামে যেখানে সে তার বড় দুই ভাইকে ফেলে গিয়েছিল. সেখানে পৌঁছেই সে একটা বড় রকমের চিত্কার ও  হইচই শুনতে পেল. লোকজনদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারল দুইজন লোককে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে. কাছাকাছি এসে সে দেখতে পেল যে ওই দুইজন লোক আর কেউ নয়, ওরই বড় দুই ভাই যারা এখন দশ্যুতে পরিনত হয়েছে. সে চিন্তিত হয়ে জানতে চাইল ওদের বাঁচার কি কোনো উপায় নেই. কিন্তু লোকজন বলল যে ওদের মুক্ত করা বেশ কঠিন ব্যাপার. শুধু একটি উপায় আছে, যদি কেউ অর্থদান করে ওদের মুক্তিপণ মিটিয়ে দিতে পারে তবেই ওরা মুক্ত হতে পারবে. এই কথা শুনে মালির ছোটছেলে আর বেশিকিছু চিন্তা না করে মুক্তিপন যা চাওয়া হয়েছিল সেটা মিটিয়ে দিয়ে বড় দুই ভাইকে  ফাঁসি থেকে মুক্ত করে দিল. তারপর তিন ভাই মিলিত হয়ে একসাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো.

ধীরে ধীরে ওরা সেই বনটিতে পৌছে গেল যেখানে শেয়ালের সঙ্গে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল. স্থানটির পরিবেশ এত শান্ত ও মনোরম ছিল যে  বড় দুইভাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, “চলো আমরা নদীর পাশে কিছুক্ষণ বসে খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম করি.” ছোট ভাইটিও ওদের কথায় সম্মত হয়ে গেল; ভুলে গেল শেয়ালের সতর্কবার্তা. অপর দুই বড় ভাইয়ের সাথে সেও নিসন্দেহে বসে পড়ল নদীর কিনারায়. কিন্তু সে কিছু সন্দেহ করে ওঠার আগেই ওই দুষ্ট দুইভাই পেছন থেকে ওকে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিল. নিজেদের সঙ্গে ওরা ধরে নিয়ে গেল রাজকুমারী, সোনালী ঘোড়া ও সোনালী পাখিটি. যথা সময়ে ওরা বাড়ি পৌছে গেল এবং রাজদরবারে রাজার সাথে দেখা করতে গেল. সেখানে পৌঁছে রাজামশাইকে ওরা বলল, “আমরা অনেক পরিশ্রম করে এসব কিছু লাভ করে নিয়ে এসেছি.” সেই রাজ্যে তখন অসীম আনন্দ উত্সবের সমারোহ শুরু হয়ে গেল. কিন্তু সোনালী ঘোড়া খাওয়া বন্ধ করে দিল, সুন্দর সোনালী পাখি আর গান গাইল না এবং রাজকুমারীর চোখের জলের বন্যা বয়ে চলল.

এদিকে মালির ছোটপুত্র নদীর খুব গভীরে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবসত নদীতে জল কম ছিল. তার শরীরের সব হাড় প্রায় ভেঙ্গে গিয়েছিল. তাছাড়াও নদীর ধারগুলো এতই গভীর ও খাড়া ছিল যে সে তীরে উঠে আসার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না. ঠিক সেই সময় আবার সেখানে হাজির হলো বৃদ্ধ শেয়াল. সে তাকে খুব তিরস্কার করলো; মনে করিয়ে দিল ঠিক সময়ে তার উপদেশ না শোনার ফল এবং এও বলল যে যদি সে তার পরামর্শ শুনত তাহলে এই দুর্দশা তার হোত না. শেষপর্যন্ত শেয়াল বলল, “আমি এত দূর এসে তোমাকে এখানে ছেড়ে যেতে পারছি না. সুতরাং তুমি আমার লেজটি খুব তাড়াতাড়ি শক্ত করে ধর.” এভাবে শেয়ালটি তার লেজের সাহায্য মালিপুত্রকে নদীর গভীর থেকে টেনে তীরে তুলে আনলো. তারপর তাকে বলল, “তোমার বড় দুইভাই তোমার উপর নজর রাখছে. সুতরাং তুমি যদি রাজ্যে ফিরে যাও তাহলে ওরা তোমাকে প্রাণে বাঁচতে দেবে না.” একথা শুনে মালির ছোটছেলে খুব দিন দরিদ্রের বেশে জীর্ণ পোশাক পড়ে গোপনে রাজ দরবারে পৌঁছে গেল. যেই মাত্র সে রাজদরবারের দরজায় পা  রাখল অমনি সোনালী ঘোড়া খাবার খেতে শুরু করলো, সোনালী পাখি গান গেয়ে উঠলো এবং রাজকন্যার চোখের জল মুছে গেল. মালির ছোটছেলে রাজার সামনে উপস্তিথ হয়ে তার বড় দুই ভাইয়ের দুষ্ট চক্রান্তের কথা জানালো. যথা সময়ে দুষ্ট দুই ভাই ধরা পরে গেল এবং কঠিন শাস্তি পেল. এভাবে ছোটছেলে তার সুন্দরী রাজকন্যা, সোনার ঘোড়া ও সোনার পাখিটিকে ফিরে পেল. এভাবে সময় বয়ে চলল. রাজার মৃত্যুর পর মালিপুত্রই পেল সিংহাসনের উত্তরাধিকার.

এভাবে দীর্ঘ বছর পার হয়ে গেল. হঠাত একদিন আপন মনে মালিপুত্র হেঁটে চলতে লাগলো আগের সেই বনের দিকে. আবার তার দেখা হয়ে গেল বৃদ্ধ শেয়ালের সাথে. এবার চোখের জলে কাতর হয়ে বৃদ্ধ শেয়াল তার কাছে প্রার্থনা জানালো শেয়ালের শরীর থেকে মাথা ও পা কেটে তাকে মেরে ফেলতে. অবশেষে মালিপুত্র তার কথামতই কাজ করলো. সেই মুহুর্তেই শেয়ালের পরিবর্তে সেখানে দেখা দিল এক অপরূপ যুবাপুরুষ. প্রকৃতপক্ষে এই যুবকই হলো বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীর ভাই.

Leave a Reply